আইনটির মধ্যে ৫টি অধ্যায় এবং ২৩টি ধারা রয়েছে। আইনটিতে ভারতীয় সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অস্পৃশ্যতা, অত্যাচার, জাতের নামে অপমান এবং ঘৃণা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অধ্যাদেশ রয়েছে তার অধীনে এসসি এসটিদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।
এই আইনটি ভারতের সমস্ত এসসি এবং এসটিদের উপর নিপীড়ন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভারতীয় সংসদ দ্বারা ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সালে পাশ করা হয়েছে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করে সরকারী গেজেটে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৩০শে জানুয়ারী থেকে এই আইন সমগ্র দেশে কার্যকরী করা হয়।
এই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে যেঃ
1 - (১) আইনটিকে Scheduled Castes and the Scheduled Tribes (Prevention of Atrocities) Act, 1989 হিসেবে গণ্য করা হবে।
(২) এই আইন জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া ভারতের সকল রাজ্য এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের জন্য কার্যকরী হবে।
(৩) কেন্দ্রীয় সরকারের গেজেটে বিবৃতি দিয়ে এই আইন বলবত করা হবে।
2- (১) এই আইনে নিপীড়নের সংজ্ঞাকে সেকশন ৩ ধারার অধীনে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে।
3- দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে নৃশংসতা জনিত অসন্তোষ এবং তার শাস্তি বিধান।
এখাণে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি সে যদি এসসি বা এসটি সমাজের কেউ না হয়, তবে সে যদি
(১) SC ST সমাজের কোন ব্যক্তিকে অখাদ্য খেতে বাধ্য করে।
(২) আঘাত করে, জাতপাত তুলে ব্যঙ্গ করে, বাডিরপাশে নোংরা আবর্জনা, বিষ্ঠা বা হানিকারক কোন পদার্থ জমা করে,
(৩) জোর করে কাপড় খুলে নেয়, বিবস্ত্র করে লোকালয়ে ঘোরাতে বাধ্য করে, মুখে চুনকালি লাগায় বা কোন ধরণের অমানবিক আচরণ করে যা অমর্যাদাকর
(৪) অন্যায় ভাবে চাষের জমি, ঘরবাড়ি, তার আওতায় থাকা কোন সম্পত্তি দখল করে নেয়,
(৫) এসসি এবং এসটির দখলে থাকা কোন জঙ্গল, জলাভূমি, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়,
(৬) SC ST সমাজের কোন সরকারী চাকরীজীবীকে যদি জোর করে ভিখারী, কৃতদাস বানানোর চেষ্টা করা হয়
(৭) SC ST সমাজের কারুর বিরুদ্ধে যদি মিথ্যে বিদ্বেষপূর্ণ, হয়রানীকর প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্র করা হয়
(৮) SC ST সমাজের চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে যদি কোন মিথ্যে অসার গুজব রটানো হয় যা ওই ব্যক্তির আইনি অধিকারকে ক্ষুন্ন করে
(১১) SC ST সমাজের কোন নারীকে আঘাত করা, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা বা তাকে যৌন নির্যাতন করা, তার সম্মানহানী করা,
(১৩) SC ST সমাজ যেখান থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে তা নোংরা করা, বন্ধ করে দেওয়া,
(১৫) SC ST সমাজের মানুষকে ঘর, বাড়ি, জমি জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে তাকে বিতাড়িত করা এই সবই চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বিশেষ আদালতঃ
দ্রুত শুনানি এবং বিচারের জন্য এই আইনে একটি বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রুল ১৩(১)এ বলা হয়েছে যে বিচারক এই কেসগুলিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিবেচনা করে এই কেসের দ্রুত রায় দেবেন। এই সমস্ত অপরাধগুলিকেই Non bell able ধারায় নিতে হবে । এই আইনে ন্যুনতম ৬ মাস প্রয়োজনে ৫ বছরের জেলের বিধান দেওয়া হয়েছে। হত্যা এবং সম্পদ লুন্ঠনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তদন্ত ব্যবস্থাঃ
রুল ৭(১) অনুযায়ী SC/ST Atrocities Act. 1989 এর তদন্ত একজন ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ (ডিএসপি) এর নিচে কোন অফিসারকে দিয়ে করা যাবে না।
▪ক্ষতিপূরণঃ
দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ বা নির্যাতনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসসি এসটি সমাজের মানুষেরা দারুন ভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাঁদের পুনর্বাসন এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এই আইনে রাজ্য সরকারকে যথোপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সদিচ্ছার অভাবঃ
SC/ST Atrocities Act. 1989 এর মধ্যে SC ST মানুষদের সমস্ত সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকারগুলির এই আইন প্রয়োগ করার ব্যাপারে সদিচ্ছার অভাব এবং অনীহা রয়েছে। সমস্ত রাজ্যে নামমাত্র বিশেষ আদালত গঠন করলেও সাধারণ মানুষ এই আইন সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ রয়েগেছে। সরকারী প্রচার মাধ্যমেও এই আইন সম্পর্কে SC ST মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। দলিত মানুষ এই আদালতের সুযোগ কিমি. নিলেও ৮০% কেস পেন্ডিং হয়ে পড়ে আছে। একটি ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই বিশেষ আদালতের জন্য ৭৭০০০ দলিত মানুষের জন্য একজন আইপিএস অফিসার নিযুক্ত করা হয়েছে।
দেশে SC ST দের বিরুদ্ধে সংগঠিত অত্যাচার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেশে এতবড় একটি রক্ষা কবচ থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট অন্য কথা বলছে।
২০১১ এর সরকারী পরিসংখ্যান বলছে-
অপরাধের ক্ষেত্রে SC-ST হওয়ার কারণে,
১) প্রতি ১৮ মিনিটে একজন SC/ST হেনস্থার শিকার হয়।
২) প্রতি দিন ৩ জন SC ST নারী ধর্ষিতা হয়।
৩) প্রতি দিন ২ জন SC ST কে হত্যা করা হয়।
৪) প্রতি দিন ২ টি SC ST বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
৫) প্রতি দিন কম বেশী একজন SC ST কে অপহরণ করা হয়। [সপ্তাহে ৬ টি]
গ্রামের অবস্থা আরো খারাপঃ
১) গ্রাম্য এলাকায় প্রতি ৩টি বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত পক্ষে একটি বিদ্যালয়ে SC ST দের জন্য আলাদা করে বসার ব্যবস্থা থাকে।
২) ২৭.৬ শতাংশ গ্রামের SC ST দের থানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না।
৩) ৩টি SC ST বাড়ির মধ্যে অন্তত ১টি বাড়িতে স্বাস্থ্য কর্মীরা যেতে অস্বীকার করেন।
৪) অন্তত অর্ধেক গ্রামে একই জায়গা থেকে SC STদের জল নিতে দেওয়া হয় না।
৫) ৭০ শতাংশ গ্রামে SC ST দের সাথে উঁচু জাতের মানুষেরা এক সাথে খেতে অস্বীকার করেন।
SC ST মেয়েদের উপরে নির্যাতনঃ
১)প্রতিদিন ৩ জন SC ST মেয়ে ধর্ষিতা হয়।
২) গ্রামের অন্তত ৭০ শতাংশ SC ST মেয়ে নিরক্ষর।
৩) হাজারে হাজারে SC-ST মেয়ে তাঁদের বয়ঃসন্ধি হওয়ার আগেই পতিতালয়ে পাচার হয়ে যায়। এবং দেশের পতিতালয়ের অন্তত ৯০ শতাংশই SC ST .
৪) দেশে যত ধর্ষণ হয় তাঁর সিংহ ভাগই SC ST মহিলা। বেশিরভাগই তাঁদের ভূ-স্বামী অর্থাৎ যাদের জমিতে খেটে খায় তাঁদের দ্বারাই ধর্ষিতা হয়। আর এই ধর্ষণের মাত্র ৫ শতাংশ থানায় রিপোর্ট হয়! যার ভেতরে ৩০ শতাংশ রিপোর্ট পুলিশ মানতে অস্বীকার করে কারণ উঁচু জাতের সামাজিক প্রতিপত্তির কথা ভেবে। [তথ্য সুত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নিউজ। ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক এ আশঙ্কাও করেছে যে অনেকেই সংখ্যার এই পরি সংখ্যান মানতে চাইবেন না, কারণ এতটাই ভয়ংকর পরিসংখ্যান!(“No one believes these numbers are anywhere close to the reality of crimes committed against Dalits. Because the police, village councils, and government officials often support the caste system…”)]
SC/ST দের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থাঃ
১) দেশে SC ST সম্প্রদায়, মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকেও দরিদ্র! ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে এমনটাই বলছে সরকারের রিপোর্ট। গ্রামের ৪৪.৮ শতাংশ ST এবং ৩৩.৮ শতাংশ SC দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে; যেখানে মুসলিমদের শতাংশ হল ৩০.৮ শতাংশ। শহরে ST ২৭.৩ এবং SC ২১.৮ শতাংশ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। যেখানে মুসলিম ২৬.৫ শতাংশ। [সুত্রঃ DNA INDIA]
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কর্ণাটকে, সেখানে ৯৩ শতাংশ SC ST পরিবার দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে!!! [সুত্রঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২০১৩]
২) প্রায় অর্ধেকের বেশী(৫৪%) SC ST শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
৩) ১০০০ এর ভেতর ৮৩ জন SC ST শিশু জন্মের একবছরের মধ্যে মারা যায়।
এতো সব কিছুর পরেও যারা দাবী করেন যে, এখন তো অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তাঁদের জন্য গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দিইঃ
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (NCRB) –র তথ্য অনুযায়ীঃ
২০০৯= হত্যা-৬২৪; ধর্ষণ-১,৩৪৬; মোট অপরাধ-৩৩,৫৯৪
২০১০= হত্যা-৫৭০ ; ধর্ষণ-১,৩১৯ ; মোট অপরাধ-৩২,৭১২
২০১১= হত্যা-৬৭৩ ; ধর্ষণ-১,৫৫৭ ; মোট অপরাধ-৩৩,৭১৯
২০১২= হত্যা-৬৫১ ; ধর্ষণ-১,৫৭৬ ; মোট অপরাধ-৩৩,৬৫৫
২০১৩= হত্যা-৬৭৬ ; ধর্ষণ-২,০৭৩ ; মোট অপরাধ-৩৯,৪০৮
২০১৪= হত্যা- ; ধর্ষণ-২,২৩৩ ; মোট অপরাধ-৪৭,০৬৪
সম্প্রতি ঘটনা এবং SC ST Atrocity prevention আইনের প্রয়োগঃ
SC ST Atrocities Act 1989 এর আওতায় যে ২০% কেস হয় তার যে কি দশা হয় তা রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার কেস থেকে প্রমানিত। এই কেসের অন্যতম আসামী ছিলেন তৎকালীন মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী, বাঙ্গারু দত্তাত্রেয় এবং হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আপ্পা রাও। সরকার প্রথমেই এই কেসকে দুর্বল করে দেবার জন্য রোহিত ভেমুলার জাতি সূচক শংসাপত্রকে জাল প্রমান করার চেষ্টা শুরু করে। তদন্তের পর ম্যাজিস্ট্রেট এই শংসাপত্রকে সঠিক বললেও পরে তা আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ঝুলে থাকে রোহিতের কেস।
উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে দলিত ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করে রান প্রতাপের জন্মদিন পালন করে রাজপুত সমাজ। এতে ৭০জনেরো বেশী রাজপুতদের উপরে এই আইন অনুসারে কেস করা হয়। এই কেসের পরে পুলিশ আসামীদের ছেড়ে দিলেও ভীম আর্মির চন্দ্রশেখর আজাদ সহ একাধিক sc/st দের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুসারে কেস করে এবং বিজেপির যোগী সরকার অত্যাচারী রাজপুতদের বিরুদ্ধে সমস্ত কেস তুলে নেয়।
২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারী ছিল ভীমা কোরেগাঁওয়ের শৌর্য দিবসের ২০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বহুজন ক্রান্তি মোর্চা । এই অনুষ্ঠানকে বানচাল করে দেবার জন্য একেবারে অতর্কিতে সন্ত্রাসবাদী কায়দায় আক্রমণ করে "ব্রাহ্মণ সভা" এবং আরএসএস। তারা আগুন জ্বালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং নিরীহ, নিরস্ত্র নারীপুরুষের উপরে লাঠি, রড, পাথর চালিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়। এই ঘটনায় প্রতক্ষ্য সংযোগ থাকার জন্য মিলিন্দ একবোটে এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির গুরুজী সাম্বাজী ভীড়ের বিরুদ্ধে SC ST (Prevention of Atrocities) Act 1989 অনুসারে কেস হয়। এই কেসে মিলন্দ একবোটে এরেস্ট হলেও এখনো সাম্বাজী ভিড়েকে এরেস্ট করা হয় নি।
No comments:
Post a Comment